সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব ও স্বাস্থ্যঝুঁকি

এইচএসসি (বিএমটি) ভোকেশনাল - ডিজিটাল টেকনোলজি ইন বিজনেস-১ - ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ ও ঝুঁকিসমূহ | | NCTB BOOK
24

সমাজ জীবনে আইসিটির ইতিবাচক প্রভাবে পাশাপাশি কিছু নেতিবাচক প্রভাবও লক্ষ করা যায়। দিন দিন অনলাইন যোগাযোগ ব্যবস্থার জনপ্রিয়তার কারণে মানুষ সামনা সামনি আলোচনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। ফলে মানুষ অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও অন্তর্মুখী হয়ে যাচ্ছে এবং হ্যাকিং, পর্ণোগ্রাফি, অনলাইন গ্যাম্বলিং ইত্যাদি অনৈতিক কর্মকান্ডে আসক্ত হচ্ছে। এভাবে আইসিটি মানুষের নৈতিক অবক্ষয়ের একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্মক্ষেত্রে আইসিটি যেমন কারও জন্য আশীর্বাদ, তেমনি কারও জন্য অভিশাপ। কারণ কম্পিউটার ও বিভিন্ন আইসিটি পণ্য কর্মক্ষেত্রে মানুষের স্থান দখল করে নিচ্ছে বলে অনেক মানুষ তাদের চাকরি হারাচ্ছে। তবে উৎপাদনশীলতা

জেনে রাখো :

সামাজিক নেটওয়ার্কের জন্যই ইন্টারনেটের ব্যবহার বেশি। বাংলাদেশের যে কোন স্থান থেকেই এখন লোকেরা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পাবেন। প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। অপরদিকে, ব্রডব্যান্ড লাইনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন প্রায় তিন শতাংশ মানুষ। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের একটি বড় অংশ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবেই ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকেন। তবে, গত কয়েক বছর ধরে ইন্টারনেট ব্যবহার করে নতুন ধরনের ব্যবসা বানিজ্য শুরু হয়েছে দেশে, যার একটি অংশ ইন্টারনেটে নানা ধরনের পণ্য কেনাবেচা করছেন।

বৃদ্ধির জন্যে এই জনশক্তিকে বিকল্প খাতে নিয়োগ করতে হচ্ছে। আইসিটি সেক্টরসহ ডিজিটাল সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের কারণে মানুষ যেসব আসক্তিতে ভুগছে তা নিম্নরূপ— 

১. কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহারে আসক্তি

বর্তমানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সাথে আসক্তির মতো ভয়ংকর একটা নেতিবাচক শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। যাদের কম্পিউটারে ইন্টারনেটের যোগাযোগ আছে তাদের কারো কারো হয়ত ফেসবুক একাউন্ট আছে। সেই ফেসবুকে সম্ভবত নিজের সম্পর্কে কোনো তথ্য দিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে কখন সেখানে কেউ লাইক দিবে। ফেসবুকে বন্ধু বাড়লে হয়তো অনেকে আনন্দ পায় এবং ঠিক কম্পিউটার গেমের মতোই ফেসবুক নামে সামাজিক নেটওয়ার্কে যতটুকু সময় দেওয়া উচিত, কেউ কেউ নিশ্চয়ই তার থেকে অনেক বেশি সময় দিয়ে ফেলে। 

চিত্র : ফেসবুক আসক্তি

তারা হয়তো জানে কাজটি করা ঠিক হচ্ছে না তারপরও সেই কাজটি না করে থাকতে পারে না। এই না পারার নামই হলো আসক্তি। মাদকের জন্যে এটি যেমন হতে পারে ঠিক সেরকম কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। মাদক জীবনের জন্য যে রকম ক্ষতিকর, অতিরিক্ত কম্পিউটার, ইন্টারনেট তথা কম্পিউটার গেম ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহারও ক্ষতির কারণ হতে পারে।

২. কম্পিউটার গেমে আসক্তি

কম্পিউটার প্রযুক্তি সম্পর্কে অনেক সময়ই অভিভাবকরা ধরে নেন, এটা দিয়ে যা কিছু করা হয় সেটাই বুঝি ভালো। ফলে তাদের সন্তানেরা দীর্ঘ সময় কম্পিউটারের সামনে বসে কম্পিউটার গেম খেলে কিংবা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে। তখন তারা বুঝতে পারেন না তাদের সতর্ক হওয়ার ব্যাপার রয়েছে। কম্পিউটার গেম এমনই এক ধরনের বিনোদন যাতে একটি ছোট শিশু থেকে পূর্ণ বয়স্ক মানুষ পর্যন্ত সবাই আসক্ত হয়ে যেতে পারে। 

চিত্র: কম্পিউটার গেম আসক্তি

কোরিয়ার একজন মানুষ টানা পঞ্চাশ ঘন্টা কম্পিউটার গেম খেলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল। চীনের এক দম্পতি কম্পিউটার গেম খেলার অর্থ জোগাড় করতে তাদের শিশু সন্তানকে বিক্রয় করে দিয়েছিল। এই উদাহরণগুলো থেকে বোঝা যায় যে, কোনো মানুষের পক্ষে কম্পিউটার গেমে আসক্ত হয়ে যাওয়া মোটেও বিচিত্র কিছু নয় এবং একটু সতর্ক না থাকলে একজন খুব সহজেই আসক্ত হয়ে যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো একটা কম্পিউটার গেমে তীব্রভাবে আসক্ত একজন মানুষের মস্তিষ্কে বিশেষ উত্তেজক রাসায়নিক দ্রব্যের আবির্ভাব হয়। যারা সপ্তাহে অন্তত ছয়দিন টানা দশ ঘন্টা করে কম্পিউটার ব্যবহার করে তাদের মস্তিষ্কের গঠনেও এক ধরনের পরিবর্তন হয়ে যায়। কাজেই কম্পিউটার গেমে আসক্ত হওয়ার পরিণতি মোটেও ভালো নয় ।

🚻 শ্রেণির কাজ : তুমি কি কম্পিউটার গেমে আসক্ত?

তুমি কি কম্পিউটার গেমে আসক্ত?
▫️হ্যাঁ▫️না

যদি উত্তর হ্যাঁ হয় তবে এর থেকে প্রতিকারের জন্য তোমার কী করা উচিৎ বলে তুমি মনে করো ।

৩. সামাজিক নেটওয়ার্ক আসক্তি

ইন্টারনেটে সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হলো এক ধরনের ওয়েবসাইট। যেখানে বন্ধুত্ব তৈরির পাশাপাশি, বার্তা বা বিভিন্ন সংবাদ আদান-প্রদান, অডিও-ভিডিও ইত্যাদি আপলোড বা ডাউনলোড করা যায়। আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পরিচিত মানুষের সাথে বিশেষভাবে যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ওয়েবসাইট। যেমন- ফেসবুক, টুইটার, অরকুট, স্কাইপি, ফ্লিকার, মাইস্পেস, ডিগ, ইউটিউব, ডায়াসপোরা ইত্যাদি ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমান সময়ে বিনোদন, যোগাযোগ, বন্ধু সৃষ্টি ও সংবাদ প্রচার ইত্যাদিতে সামাজিক ওয়েব সাইটের ব্যবহার এক রকম অপরিহার্য হয়ে গিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, সামাজিক যোগাযোগ সাইটে আসক্তি ধীরে ধীরে সারা পৃথিবীর জন্যেই একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এই সাইটগুলোর সাফল্য নির্ভর করে সেগুলো কত দক্ষতার সাথে যে কাউকে আসক্ত করতে পারে তার উপর। পুরো কর্মপদ্ধতির মাঝেই যে বিষয়টি রয়েছে, সেটি হচ্ছে কত বেশি বার এবং কত বেশি সময় একজনকে এই সাইটগুলোতে টেনে আনা যায় এবং তাদেরকে দিয়ে কোনো একটা কিছু করানো যায়। কাজেই কেউ যদি অত্যন্ত সতর্ক না থাকে, তাহলে তার এই সাইটগুলোতে পুরোপুরি আসক্ত হয়ে যাবার খুব বড় একটা সম্ভাবনা রয়েছে। জেনে হোক না জেনে হোক ব্যবহারকারীরা নিজের সম্পর্কে অত্যন্ত তুচ্ছ খুঁটিনাটি তথ্য সবার সামনে উপস্থাপন করে এবং প্রত্যাশা করে কেউ সেটি দেখলে সে খুশি হবে; আর কেউ পছন্দ করলে ব্যবহারকারী আরো বেশি খুশি হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি অনেকটা মাদকের মতো কাজ করে এবং ব্যবহারকারী ঘন্টার পর ঘন্টা তাদের মূল্যবান সময় অপচয় করতে দ্বিধাবোধ করে না।

🔳 ফেসবুক ও টুইটারের মধ্যে পার্থক্য কি?

▪️ফেসবুক একটি সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট, যা একজন ব্যক্তিকে একটি বৃহৎ গ্রুপের সাথে সংযুক্ত করে। টুইটার একটি অনলাইন ওয়েবসাইট, যা নিবন্ধিত ব্যবহারকারীদের ছোট বার্তা অর্থাৎ টুইটগুলি পড়তে ও সম্প্রচারের অনুমতি দেয়।

▪️ফেসবুকে একজন ব্যবহারকারী চ্যাট করতে, ছবি আপলোড করতে, ভিডিও বা লিঙ্ক শেয়ার করতে, কল করতে (ভয়েস এবং ভিডিও), পোস্ট করতে এবং স্ট্যাটাস দিতে পারে। তবে টুইটারটি মাইক্রোব্লগিং বৈশিষ্ট্যের জন্য জনপ্রিয়।

▪️ফেসবুক ২০০৪ সালে চালু হয়েছিল, যেখানে টুইটার ২০০৬ সালে তৈরি হয়েছিল। ফেসবুকে বাস্তব জীবনের বন্ধুদের সাথে বা অপরিচিতদের সাথে ভার্চুয়্যালি বন্ধুত্ব করা যায়। টুইটারের ক্ষেত্রে, ব্যবহারকারী কেবল অনুসরণ করে।

▪️ফেসবুক তাৎক্ষণিক বার্তা প্রেরণে সক্ষম, তবে টুইটার তা করে না।

▪️ফেসবুকে যেকোনো দৈর্ঘ্যের স্ট্যাটাস পোস্ট করা যায়। টুইটারে ১৪০টির বেশি অক্ষরের পোস্ট দেয়া যায় না।

এইসব আসক্তির কারণে সমাজে যেসব সমস্যা তৈরি হচ্ছে তা নিম্নরূপ—

▪️অশ্লীলতা : ইন্টারনেটে অনেক অশ্লীল এবং নগ্ন প্রচারণায় মানুষের নৈতিক চরিত্রের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে । বিশেষ করে শিশু ও কিশোরদের বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমেই বাড়ছে। 

▪️গোপনীয়তা: তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা অনেকক্ষেত্রে প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে, যা মোটেই কাম্য নয়। 

▪️ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব : তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সর্বত্রই অটোমেশনের ছোঁয়া লেগেছে। ফলে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রতিনিয়তই বেকারত্ব বাড়ছে।

▪️শারীরিক সমস্যা : তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ডিভাইসসমূহ বিভিন্ন প্রকার স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য দায়ী, যেমন— চোখের উপর চাপ, কব্জির ক্ষতি, পিঠের সমস্যা, মানসিক চাপজনিত সমস্যা প্রভৃতি।

▪️অপসংস্কৃতি ও মিথ্যাচার : তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিকাশের ফলে অপসংস্কৃতি, মিথ্যা প্রচারণা ইত্যাদি মানুষের জীবনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করছে। বিশেষ করে ভিনদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসনের ফলে দেশি সংস্কৃতি হারাতে চলেছে। বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ব্লগ সাইট, ফেসবুক, টুইটার ব্যবহার করে কারো ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি, সংবাদ এডিট করে, মিথ্যা ছবি বা তথ্য প্রকাশ করে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে জাতিগত দাঙ্গা-ফ্যাসাদ তৈরি হচ্ছে।

▪️অপরাধ প্রবণতা: সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তির ফলে তরুণ সমাজের মধ্যে আচার-আচরণ, পোষাক পরিচ্ছেদ, মানসিকতা, শ্রদ্ধাবোধ প্রভৃতি বিষয়ে উদ্বেগজনক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। যা তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা তৈরি করে।

▪️সামাজিক সমস্যা : ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদির ব্যবহারের ফলে বিবাহ-বিচ্ছেদের মতো ঘটনাও ঘটছে। শিশু-কিশোররা ভায়োলেন্স গেইম খেলার প্রভাবে এবং অশ্লীতার কারণে সামাজিক অপরাধ ক্রমেই বাড়ছে, যা বর্তমান সময়ের একটি বড় সমস্যা।

▪️বুদ্ধিমত্তার ক্ষতিগ্রস্ততা : তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে মৌলিক গবেষণা থেকে মানুষ দূরে থাকবে। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে প্রায় সব ধরনের সমস্যার সমাধান সহজে পাওয়ার কারণে চিন্তা ও গবেষণার মাধ্যমে নতুন কিছু আবিষ্কার হতে দূরে থাকবে। ফলে আমাদের সমাজ ও জাতি মেধাবী প্রজন্ম হতে বঞ্চিত হবে।

Content added || updated By
Promotion